গুরুত্বপূর্ণঃ
অতুলপ্রসাদ সেন, (১৮৭১-১৯৩৪) কবি, গীতিকার, গায়ক।
১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুরের দক্ষিণ
বিক্রমপুরের মগর গ্রামে। বাল্যকালে পিতৃহীন হয়ে অতুলপ্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকণ্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে
প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তাঁর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়।
|
অতুলপ্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা
পাসের পর কিছুদিন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে বিলেত থেকে
ব্যারিস্টারি পাস করে তিনি কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং পরে
লক্ষ্ণৌতে স্থায়িভাবে বসবাস করেন। সেখানে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে
প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আউধ বার অ্যাসোসিয়েশন ও আউধ বার কাউন্সিলের সভাপতি
নির্বাচিত হন। লক্ষ্ণৌ নগরীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে
জড়িত হয়ে পড়েন।
|
অতুলপ্রসাদ প্রবাসী (বর্তমানে
নিখিল-ভারত) বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি উক্ত সম্মিলনের মুখপত্র উত্তরার একজন সম্পাদক এবং সম্মিলনের কানপুর ও
গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও
প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, পরে লিবারেলপন্থী হন।
অতুলপ্রসাদ তাঁর সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থের বৃহদংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয়
করেন; এমনকি তিনি তাঁর বাসগৃহ ও গ্রন্থস্বত্বও বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান।
|
বাংলাভাষীদের নিকট অতুলপ্রসাদ
প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তাঁর গানগুলি প্রধানত
স্বদেশীসঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান এ তিন
ধারায় বিভক্ত। তবে তাঁর ব্যক্তিজীবনের বেদনা সকল ধরণের গানেই কম-বেশি প্রভাব
ফেলেছে। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণরস-প্রধান।
|
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের
মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যাঁরা
বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুলপ্রসাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সমকালীন গীতিকারদের তুলনায়
অতুলপ্রসাদের সঙ্গীতসংখ্যা সীমিত হলেও তাঁর অনেক গানে সাঙ্গীতিক মৌলিকত্ব
পরিলক্ষিত হয়; আর সে কারণেই তিনি বাংলা সঙ্গীত-জগতে এক
স্বতন্ত্র আসন লাভ করেন। তাঁর গানগুলি অতুলপ্রসাদের গান নামে প্রতিষ্ঠা পায়।
|
১৯০২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত
অতুলপ্রসাদ আইনব্যবসা উপলক্ষে লক্ষ্ণৌতে অতিবাহিত করেন। সে সময় তাঁর বাংলোতে
প্রায় সন্ধ্যায়ই গানের আসর বসত। সে আসরে গান শোনাতে আসতেন আহম্মদ খলিফ খাঁ, ছোটে মুন্নে খাঁ, বরকৎ আলী খাঁ এবং আব্দুল
করিমের মতো বিখ্যাত ওস্তাদগণ। ভালো সঙ্গীতের আসর পেলে তিনি আদালত ও মক্কেলের কথা
ভুলে যেতেন। অতুলপ্রসাদ অধিকাংশ গান লক্ষ্ণৌতেই রচনা করেন। তাঁর গানের সংখ্যা
মাত্র ২০৬ এবং সেসবের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হয়।
|
অতুলপ্রসাদের মামাতো বোন সাহানা
দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকলি (১৯৩০) নামে দু খন্ডে প্রকাশিত হয়।
তাঁর অপর গানগুলিও গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত
হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুলপ্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয়
সাহানা দেবী ও হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। পরে যেসব শিল্পী তাঁর গান গেয়েছেন
তাঁরা সুর-তালের ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন করায় তা নিয়ে কিছুটা বিতর্কেরও সৃষ্টি
হয়।
|
বাংলা সঙ্গীতে অতুলপ্রসাদই প্রথম
ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। এ ছাড়া রাগপ্রধান ঢঙে বাংলা গান রচনা তাঁর থেকেই শুরু
হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলায় ঠুংরি গীতধারার প্রথম
প্রচলন করেন লক্ষ্ণৌর বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্। অতুলপ্রসাদের
বিশেষত্ব এ যে, তিনি বাংলা গানের সুর-তালের বৈশিষ্ট্য
অক্ষুণ্ণ রেখেই হিন্দুস্থানি রীতির প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। জীবনের প্রায়
অর্ধেক সময় তিনি উত্তর ভারতে কাটান। সেজন্য ওখানকার সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে
মিশে গিয়ে তিনি হিন্দুস্থানি গীতিপদ্ধতিকে রপ্ত করতে সমর্থ হন। তাই বাংলা গানে
হিন্দুস্থানি ঢঙের মিশ্রণ ঘটানো তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল। অতুলপ্রসাদের এ প্রয়াস
বাংলা গানে একদিকে যেমন নতুনত্ব এনেছে, অন্যদিকে তেমনি
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ উন্মুক্ত করে বাংলা গানের জগতে এক বন্ধনমুক্ত শৈল্পিক আবহ
নির্মাণে সক্ষম হয়েছে।
|
হিন্দুস্থানি লঘু খেয়াল, ঠুংরি ও দাদরা সঙ্গীতের
সুষমামন্ডিত সুরের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
হিন্দুস্থানি সুর সংযোজনায় বাংলা গানের কাব্যিক মর্যাদা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে
বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করলেও একটি স্বতঃস্ফূর্ত সাঙ্গীতিক ভাব তাঁর সকল গানে
পরিলক্ষিত হয়। যেখানে সুর সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত মাধুর্য নিয়ে কথার ভাবকে
ছাড়িয়ে গিয়েছে সেখানেই অতুলপ্রসাদের সার্থকতা। তাঁর ঠুংরি ও দাদরা ভঙ্গির
গানগুলি শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। এমন কয়েকটি গান হলো: ‘কি
আর চাহিব বলো’ (ভৈরবী/টপ
খেয়াল), ‘ওগো নিঠুর
দরদী’ (মিশ্র
আশাবরী-দাদরা/টপ ঠুংরি), ‘যাব না যাব
না ঘরে’ (ঠুংরি)
ইত্যাদি। তাঁর রাগপ্রধান গানের মধ্যে ‘বঁধু
ধর ধর মালা’
(কালিংড়া), ‘তবু তোমায়
ডাকি বারে বারে’ (সিন্ধু
কাফি) ইত্যাদি গান আজও সঙ্গীতবোদ্ধাদের নিকট সমান প্রিয়। অতুলপ্রসাদ রাগপ্রধান
ঢঙে বাংলা গানে যে সুর সংযোজন শুরু করেন, তা পরে একটি
শক্তিশালী ধারা হিসেবে বিকশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং রাগপ্রধান অঙ্গের
অন্যান্য আধুনিক গান এভাবে একটি স্বতন্ত্র ধারা
হিসেবে গড়ে ওঠে।
|
অতুলপ্রসাদের অপর কৃতিত্ব ধ্রুপদ ও কীর্তনের সুরসমন্বয়ে
সঙ্গীত রচনা, যেমন ‘জানি
জানি হে রঙ্গ রানী’ (তিলক
প্রমোদ)। তাঁর গানে খাম্বাজরাগের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়াও নটমলার, নায়কী কানাড়া, কাফি, পিলু প্রভৃতি রাগের মিশ্রণেও তিনি গান রচনা করেছেন। অতুলপ্রসাদের কীর্তন, বাউল এবং রবীন্দ্র আঙ্গিকে
রচিত স্বদেশী গানগুলি বাংলা সঙ্গীতের জগতে মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করে আছে,
যেমন: ‘হও
ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’, ‘উঠ
গো ভারত লক্ষ্মী’ ইত্যাদি।
|
ছোটবেলায় ঢাকা ও ফরিদপুরে বাউল, কীর্তন ও মাঝি-মালাদের ভাটিয়ালি গানের মূর্ছনা অতুলপ্রসাদের হূদয়ে স্থায়ী আসন লাভ
করেছিল। সে সুরের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত তাঁর বাউল ও কীর্তন ঢঙের গানগুলিতে
বাংলার প্রকৃতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। অতুলপ্রসাদ প্রেম, ভক্তি, ভাষাপ্রীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক বহু গান রচনা করেছেন।
১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌয়ে সর্বভারতীয়
কংগ্রেস অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়ক হিসেবে তিনি যে দেশাত্মবোধক গানটি
রচনা করেন, তাতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের সুর আছে: ‘দেখ
মা এবার দুয়ার খুলে/ গলে গলে এল মা/ তোর হিন্দু-মুসলমান দু ছেলে’। ‘মোদের
গরব, মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা’
গানটিতে অতুলপ্রসাদের মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। এ গান বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের মধ্যে অফুরন্ত প্রেরণা
জুগিয়েছে। গানটির আবেদন আজও অম্লান। এভাবে বাণীপ্রধান গীতি রচনা, সুললিত সুর সংযোজন, সুরারোপে
পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রচলন ও করুণরস সঞ্চারের মাধ্যমে অতুলপ্রসাদ বাংলা
সঙ্গীতভান্ডারকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট লক্ষ্ণৌতে তাঁর
মৃত্যু হয়।
|